মদসংখ্যা- বৃষ্টি ।। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ
Art thou abroad on this stormy night on thy journey of love, my friend?
The sky groans like one in despair.
I have no sleep tonight. Ever and again I open my door and look out on the darkness, my friend.
I can see nothing before me. I wonder where lies thy path.
By what dim shore of the ink-black river,
By what far edge of the frowning forest,
Through what mazy depth of gloom art thou threading thy course to come to me, my friend?
(Song 23, Song Offerings – Rabindranath Tagore)
লোকায়ত পান্থশালা থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। চারদিক্ ধুধু, আর ফাঁকে ফাঁকে ছোপ ছোপ রাত। অস্থির বাতাস, দিগ্বিদিক্। মাটি থেকে ছোট-বড় কুণ্ডলীতে ওঠে ঘূর্ণি-ধূলি। তারার বদলে, আকাশে এক-আকাশ নিকষ নিরেট মেঘ। তাকে চিরে থেকেথেকে ড্রাগন-জিভের উল্লোল। একটা সুন্দর মুখ মনে পড়ল আমার। কে জানে কার। আমরা চলতে থাকি বাতাসে দুলে-দুলে, একটা আধো-আধো বনের মাঝখান দিয়ে। যা আসলে হয়তো বন নয়। কিন্তু এই আনখা লগনে, বন ছাড়া সে আর কী? সমাহিত আমরা হাঁটছি— ঝড়টাকে পুরোদূর আমল না-দিয়ে। শান্ত বলে, ‘দেশলাইটা জ্বালো। কিছু দেখতে পাচ্ছি না আমি।’ দেশলাই জ্বলে না। তিনজনই খানিক বিমর্ষ হই। যেন দেশলাইয়ের জ্ব’লে-ওঠাটা ছিল ভীষণ জরুরি। একটা ওমেনের মতো, ঘটনাটা দারুণ নাড়িয়ে দেয় আমাদের। শান্ত বলে, ‘আমাকে মাঝে রাখো। ভালো লাগছে না আমার।’ একটা পাকুড় গাছের নীচে আমরা দাঁড়াই। গাছটা পাকুড় কিনা জানি না। আলোচনা করতে চাই, কী এখন করব আমরা। কিছুই আমরা করতে পারি না স্থির। রাস্তাটা কোন্ দিকে ভুলে গেছি। শান্ত বলে, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাব।’ ‘না!’ বলে শাহিন, ‘আমাদের এগিয়ে যাওয়াই চাই।’ আমিও একমত— ‘থেমে থাকা চলবে না।’ আকাশে কোটি-কোটি ক্রেটারের বিস্ফোরণ। মা বলত, দেবাসুরের যুদ্ধ। শান্ত বলে, ‘আমি ঘুমাব।’ ‘ও ঘুমাক তবে,’ শাহিন বলল, ‘আমরা এগোই। পথটা খুঁজে পেলে ওকে তুলে নে’য়া যাবে।’ মাথার উপর ডানা ঝাপটায় একটা টুকরো-আঁধিয়ার। সেটা বাদুড় হ’তে পারে, বা আরকিছুও। শাহিন আর আমি চলি এগিয়ে। চলাটা ক্রমশঃ উঁচুনিচু হয় আমাদের। যেন পাহাড়িয়া দেশ। দেশলাইটা আবারও আমি জ্বালবার চেষ্টা পাই। একে-একে সবক’টি কাঠিই নেভে। দেশলাই জ্বলে না। এক বোবা ক্রোধে, খালি-বাকশোটি আমি ছুঁড়ে ফেলে দিই। কিন্তু পতনের শব্দ কানে আসে না সেটার। যেন সেটি আমার হাত থেকে ছিটকে গিয়ে গুলে গেছে অন্ধকারে, মাটিতে পড়ার আগেই। বিপৎসূচক সাইরেনধ্বনির মতো উচ্চাবচ হাওয়ার ওঙ্কার। উদারা-মুদারা-তারার কালাতীত কালোয়াত। শাহিন হোঁচোট খেয়ে প’ড়ে গেল হঠাৎ। মাথাটা ওর ঠুকে গেল একটা টুকরো-পাথরে। অন্ততঃ তা-ই আমার মনে হ’ল। গোঙাতে-গোঙাতে বলল ও, ‘শুভ, আমরা কোথায় যাব?’ আমার গলায় প্রতিধ্বনি— ‘কোথায় যাব—’ ‘শুভ, আমাকে ধরো, হাঁটতে পারছি না আমি।’ সত্যই খোঁড়াচ্ছে ও। একটা ঝলকে দেখতে পাই, ওর কপালে এক আড়াআড়ি চিড়, তা থেকে আলাদা তিনটি ধারায় রক্ত চোয়াচ্ছে। আমি আমার শার্টের একটা আস্তিন ছিঁড়ে ওর কপালে বাঁধতে-না-বাঁধতেই, চোখের নিমেষে— বৃষ্টি— এমন সূচিবেধ্য সান্দ্রধারায়, যে, মনে হ’ল আমরা ডুবুরি, হাঁটছি সমুদ্রতলের মাটিতে, ঝড়ের সমুদ্রে। শাহিন শনৈঃ শনৈঃ এলিয়ে পড়তে থাকে। আমি, জেলিমাছ-থলথলে কালো-কাদার উপরে ওকে ধ’রে-ধ’রে নিয়ে চলি। সহসা মনে পড়ে শান্তর কথা। ভাবি, ও বোধ হয় ম’রে গেছে, কিংবা শুয়ে আছে চিৎপাত, লোকায়ত পান্থশালার কোনো টেবিলে, ওর মুখে ঝুঁকে আছে একটা সুন্দর মুখ। মুখটা আমার পরিচিত নাকি? ‘শাহিন! শাহিন! শাহিন!’ শাহিন আবার প’ড়ে গেছে। সাড়া দিচ্ছে না। আমি ওকে কাঁধে তুলতে যাই। কিন্তু আমার পায়ের নীচে পাঁক, একতাল কেঁচোর মতো হিলহিলিয়ে ওঠে। ওর পাশেই আমি পপাত, কাটা-গাছের মতো। উঠতে গিয়ে আবার পড়লাম, গড়াগড়ি খেলাম। শীতের কৈয়ের মতো ল্যাপ্টানো দু’জনেই। হাচড়ে-পাছড়ে দাঁড়িয়ে, একটা হাত ধ’রে হিঁচড়ে নিয়ে চলি ওকে, কাটা-গাছের মতো। বিকট আওয়াজে একটা বাজ ফাটল কাছেপিঠে কোথাও। চমকে গিয়ে হাত ছেড়ে দিই শাহিনের। মুহূর্তের জন্য, একটা জোনাকিজ্বলন্ত রাত মনে এল : থোকায়-থোকায় সবুজাভ নিয়ন, অন্ধকার পুকুরের আকাশে শূন্যের ভিতর জ্ব’লে উঠছে, আবার শূন্যে যাচ্ছে মিলিয়ে, আর, এক-কাঁসার-বাটি দুধ কাৎ হ’য়ে শুধু গড়িয়েই যাচ্ছে অনর্গল— কলকল কলকল। বৃষ্টি এবার ডানদিক্ থেকে আসছে। গায়ে বিঁধছে ভীষণ। এক-পঙ্গপাল বোলতা বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। বোলতার কামড়ে একবার জ্বর হয়েছিল আমার। সারা গায়ে চুন মেখে, তিতা পাঁচন গিলতে হয়েছিল ক’দিন। ঐরকমভাবেই আমি চিনেছিলাম বোলতাকে। ডানহাতটা ক্রমশঃ অবশ। ডানকাঁধটা মনে হয় ফুলে-ফুলে অনেক বড় একটা বস্তা। ভিতরে কিলবিল-কিলবিল কাঁকড়াবিছা আর চ্যালা। তবু এখন আমার মনে হচ্ছে, আমার হাতের সাথে সাঁটা শাহিনের নিথর দেহটা, আমারই শরীরের এক দুর্ভর, নির্জীব, সম্প্রসারণ— গলগণ্ড যেন। টিকটিকির ল্যাজের মতো— বিচ্ছিন্ন না-করলে যেন প্রাণ আসবে না ওতে। আমার সর্বেন্দ্রিয় ছটফটিয়ে উঠল ওকে ছেড়ে দেবার তাগিদে। কিন্তু ওর আমার হাতের বন্ধনের উপরে আমার কোনো কর্তৃত্ব নেই মনে হ’ল। আমি সাঙ্ঘাতিক বিরক্ত হলাম আর আমার বমি-বমি লাগল। হাঁটু গেড়ে ওর পাশেই ব’সে পড়ি আমি। হয়তো উঠতামও না আর কোনোদিন, যদি না, একটা ঝলকে চোখে পড়ত, আমাদের দশ গজ বা দশ ফুট দূরে, একটা প্রাসাদের ফাসাদ। আমি আমাকে ফিরে পেলাম আবার। তীব্র সুখে— ‘শা হি ন! দ্যা খো!’ শাহিন যথারীতি টুঁ-শব্দ-রহিত। কিন্তু দ’মে গেলাম না আমি। ওকে এবার বহুকষ্টে কাঁধে তুলতে পারাও গেল। এই জায়গাটা তত খারাপ নয়, প্রায় কিছুই না দেখেও বোঝা গেল। এক অদৃশ্য কাঁটাঝোপে আমার কাপড় আটকায় হঠাৎ। কিছুতেই ছাড়ানো যাচ্ছে না। অক্টোপাসের মতো,— একদিক্ ছাড়াই, সাতদিক্ জড়ায়— কিংবা, মাংসাশী গাছের মতো। শেষে, দেহের অবশিষ্ট শক্তিকে কেন্দ্রীভূত ক’রে, একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই, আমার কাপড় আর চামড়ার বেশ খানিকটা র’য়ে গেল ঝোপে, কাঁধ থেকে প’ড়ে গেল শাহিন। আবার— আমি ওকে কাঁধে তুললাম, কীভাবে কে জানে, আর ঐ আবছা বাড়িটার আবছায়ার দিকে আগালাম। হরকদম এক-একটি শত্রুপুরী ভূমিসাৎ— পুরন্দর মনে হয় নিজেকে। বাড়িটার পোর্চে, কাচপুতুলের যত্নে, শাহিনকে শুইয়ে দিলাম পাকায়। বাড়িটাকে একবারও পুরাপুরি, কিংবা আধাআধিও দেখি নি। কিন্তু এ-মুহূর্তে মনে হ’তে লাগল, এ-ই আমার ঘর— এই বাড়িটা ছাড়া আর-কোনো মোকাম, আর-কোনো মঞ্জিল আমার নাই,— ছিল না। বাস্তবিক, আমার প্রায় বিশ্বাস হ’য়ে যায়, যে, ভিতরে রাত জেগে ব’সে আছে মা, আমার মা। একটা তিন-সিকি-ভাগ পোড়া মোমবাতি, মা-র রক্তরিক্ত সাদা-মুখের ’পরে আবির ছিটিয়ে-ছিটিয়ে কাঁপছে— আমার মায়েরই দুরুদুরু হৃৎপিণ্ডের তালে। আমি বিহ্বল— সত্যই ‘মা মা’ চিৎকার দিই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, চিৎকারটা আমি করি নি। দরজাটা হাতড়ে দেখি, সেটা অস্বাভাবিক বড়— ভারি, মজবুত কোনো কাঠের, গায়ে খোদাই করা ল্যাবিরিন্থাইন নক্শা। কিন্তু কড়াটা কোথাও খুঁজে না পেয়ে, পাল্লার উপর হাতের চেটো দিয়ে বার-কয় আঘাত করি। বার-কয় একটা চাপা হুঙ্কারের মতো বদ্ বদ্ শব্দ হয়, আর নক্শার একটা কোণ-বের-করা ধারে লেগে আমার হাত ছ’ড়ে যায়। ‘কেউ আছেন?’ প্রাণপণ ডাকি— ‘দরজাটা একটু খুলবেন?’ উত্তর মেলে না। শুধু অবিরল বৃষ্টির লাগাতার ঝমঝম। আমি আবার ডাকলাম, আবার ডাকলাম, আবার, আবার, আবার, আবার, আবার। ঝমঝমঝম। একটু পিছিয়ে গিয়ে, দৌড়ে এসে কাঁধের ধাক্কা দিলাম দরজায়। বদ্। দরজা একসুতা নড়ল না। আবার। বদ্। ঝমঝম। আবার। বদ্। ঝমঝমঝম। নিরস্ত ব’সে পড়ি আমি। মনে-মনে কীএকটা হিসাব কষি। মেলে না। খুব ভয় হয়— কিছু করা দরকার। এক্ষুনি। আবার বৃষ্টিতে নামি। কিছু করা দরকার। কিছু করা চাই-ই। এ-বাড়িটা পোড়ো হ’তে পারে। কিন্তু ভিতর থেকে বন্ধ কেন তাহলে? ভেবে না-পেয়ে আমি ভাবনা থামাই। আশেপাশে নিশ্চয় বাড়ি আরও আছে, সেখানে মানুষ আছে, মানুষ! একটা অন্ততঃ সজীব মানুষের জন্য প্রাণ আমার ককিয়ে ওঠে। আমি আরও দ্রুত চলতে থাকি। এবার জায়গাটা ক্রমশঃ উঁচু। আরও উঁচু, আরোও। পাহাড়ে চড়ছি নাকি? অনেক অনেক উঁচুতে চড়বার পর, একটা পাকুড় গাছের নীচে জিরাতে থামি। গাছটা পাকুড় কিনা জানি না। ঝমঝমঝম— আর কলকলকল পানি গড়িয়ে আসছে, আমার ফুলে-ফুলে-ঢোল জুতার উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগল না আমার। জুতা খুলে ফেলে দিয়ে, গাছের পায়ের কাছে একটা মোটা-শিকড়ে উঠে বসি। কীএকটা যেন দোল খেয়ে আমার ভেজা গালে এসে সেঁটে যায়। আতঙ্কে কাঠ হ’য়ে তবু রোবটের হাত দিই গালে। একটা লতা, বা দড়ি। দড়িই। গাছ থেকে ঝুলছে। আশ্বস্ত হলাম আমি। কিন্তু গাছে দড়ি কেন ঝোলে? ঝুলুক গে। ঘুরে পিছনে তাকাতেই, একটা ঝলকে, অনেক-অনেক-নীচে-ফেলে-আসা বাড়িটা দেখতে পাই। ধোঁয়াশাধূসর। ক্যানভাস-জোড়া এক জাম-কালো প্রেক্ষাপটে একটু রঙ গেছে যেন-বা চটকে। এক প্রায়াচ্ছ রুমাল বুঝি। এক চালাক-চতুর, আমাকে-ছোঁও-তো-দেখি রুমাল। রুমালগুলি সব এমনই। কিন্তু বাড়ি নয়, গির্জা। গথিক। তবে স্বর্গ-পানে-ধাওয়া-করা ছুঁচালো-উঁচু নয়। বরং, চিৎপাত-ফেলে-রাখা বাকশোর মতো। মাথার দিক্টায় কেবল, একটা উঁচু স্পায়ার। আরেকটা ঝলসানিতে আবার, গির্জাটাকে একটা বিরাট্ কবর মনে হয়। মুখ ঘুরিয়ে নিই। আর তখনই— মাটি থেকে ছিটকে এসে ছোট্ট একটা কালো কী-যেন, আমার বাঁ-পায়ের পাতার উপর পড়ল। প’ড়েই থাকল। আমার মনে হ’ল, ওটা ব্যাং। ভীষণ ক্রোধ হ’ল, ভীষণ! ঝাঁকরাতে গিয়েও, রাশ টানলাম পায়ের। খুন করতে হবে, ওটাকে খুন করবই আমি! পকেট হাতড়ে একটা বলপেন জোটে। পেনটাকে চাকুর মতো ধ’রে, খুব সাবধানে বাঁ-পায়ের উপর এনে তীব্র কোপ বসাই। আআআআআঃ! বোঁ ঘুরে ওঠে মাথা। পেনটা ইঞ্চিখানেক ঢুকে গেছে পায়ের পাতায়। ইঞ্চিখানেকই মনে হয়। হতচ্ছাড়া ব্যাংটা লাফিয়ে ঢুকে গেছে আঁধারে। কলমটা গেঁথে আছে। ওঠাতে পারছি না। ভয়, ওঠালে, ঐ গর্ত দিয়ে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসবে শরীরের সব ক’-ফোঁটা রক্ত। বাকি সারাজীবন পায়ে কলম-গাঁথা হ’য়েই বাঁচবার কথা মনে-মনে ভেবে ফেলি লহমায়— অনেক মুক্তিযোদ্ধা যেমন বেঁচে আছে, পাঁজরে বুলেট-গাঁথা হ’য়ে। গাছের গুঁড়িতে ঠ্যাসান দিয়ে ব’সে, গাঁজাখোরের মতো দম আটকাই। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাকে শাসন করি। আর যন্ত্রণাটা শিকড় বেয়ে শরীরের শাখাপ্রশাখা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।… পায়ে-ব্যান্ডেজ-বাঁধা, আর, পা-টা শূন্যে ঝোলানো, আর, একটা সুন্দর শানাই বাজছে, শানাই বাজলেই মনে হয় বিয়ে হচ্ছে, এমনকি আমার বিয়ে হচ্ছে, লজ্জা হয় কেমন, আর খুব কান্না আসে… ভাবতে-ভাবতে একটু-বা ধ’রে এল ব্যথা। এক রাতে খুব শানাই বেজেছিল, এই বৃষ্টির মতো শানাই বেজেছিল, গুণকলি, আর মনে হয়েছিল, একটা পেথিডিন-গোলাপি তন্দ্রার ভিতর দিয়ে এক আযোজন পুষ্পান্ন উৎসবে কলাবতীর পাত পেতে বসেছি।… তিনটি জমাট অন্ধকার, তরল অন্ধকারের ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসছে ছপছপছপছপ। আমি চেঁচাই, ‘কাঁরা যাচ্ছেন? একটু শুনুন না!’ ভয়, চ’লে যায় বুঝি। আবার চেঁচাই, ‘এই যে—’ চ’লে গেল না ওরা। সামনে এসে দাঁড়াল। তিনজন বুড়ি— তাই মনে হ’ল আমার। কোথায় যাচ্ছে এরা এই বৃষ্টিতে? ভয়ে জিজ্ঞাসা করি না। যদি রেগে যায়, রেগে চ’লে যায়। একটু হাসবার চেষ্টা ক’রে বলি, ‘এত বৃষ্টিতে হাঁটছেন? এই গাছটার নীচে একটু দাঁড়াতেন না-হয়। বৃষ্টি ধ’রে এলে একসঙ্গে যাওয়া যেত।’ তারা কিছু শুনল কিনা কে জানে, আমার মুখের ’পরে ঝুঁকে এল, আমাকে দেখবার উৎসাহে বোধ হয়। এবার আমি তাদের মুখের আদলগুলি দেখলাম। সেগুলায় বেশ মিল রয়েছে মনে হ’ল। তিন বোন কি? নাকি বুড়িমাত্রেরই একই রকমের আদল হয়? কে জানে। আমাকে চিনল নাকি ওরা? হেসে কেন উঠল তবে? একসাথে? আমি ওদের দাঁত দেখতে পেলাম। না, আমি ওদের দাঁত দেখতে পেলাম না। দাঁত নেই। তিনটা কালো-ফোকর। গা কেমন গুলিয়ে আসে আমার। একটাও বুড়ির দাঁত নেই! কত বুড়া এরা? আমি নিজের দাঁতে একবার ঠোঁটটা কামড়াই। ডানদিকের বুড়ি বলে, ‘আমায় চিনতে পারছ, অ সোনা!’ মাথা নাড়ি। ‘বল কী বাছা! মায়েরে চিনতে পারলে না!’ বলে কী এ! কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করবার আগেই, সামনের বুড়ি— ‘তা, তুই একরকম ওর মা-ই বটে। ছোট্টকাল হ’তে তোর কোলেপিঠেই তো বাড়ল। আমি তো সেই-যে ব্যামোয় পড়লাম…’ ‘খুব ভালো,’ বাঁয়ের বুড়ি বলে এবার, ‘তোরা দু’টিতে খুনসুটি কর, চিরটাকাল যা করছিস। ওরা তোর মাসি বাছা। চিনতে পারিস-নি? তা পারবি কেন— কতকাল হ’য়ে গেল। তা আমায় দেখে চিনে নে।’ ভীমরতি হয়েছে নাকি এদের? তা হ’তেও পারে। যে বুড়া। বললাম, ‘আপনাকে দেখে চিনব মানে?’ ‘অ জাদু! আজও কলা ভুলিস-নি! সেই যে— মনে আছে তোদের? — কীভাবে মা বদ্লাত ও রোজ? হিহিহিহি।’ আমি বিরক্ত। এ-তো পাগলের কারখানায় পড়া গেল। ‘খিদে লেগেছে সোনা? দুধ খাবি?’ বাঁয়ের বুড়ি— ‘আয়।’ বুকের কাপড়টা ঘুচিয়ে সে দেয়। আর, আমার চোখদু’টি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসে— আমসি-শুকনা মাইয়ের জায়গায় দু’টি পোয়াতি-ভরাট পয়োধর। একেবারে টৈটম্বুর। একটু খোঁচা দিলেই বুঝি দুধ গড়িয়ে পড়বে। আমি হতবাক্ তাকাই অন্য দু’বুড়ির দিকে। তারাও বুকের বাস খশিয়েছে। হুবহু স্তন— আহ্! ছ’ছ’টি উন্মুখ, উন্মুখর স্তন, পৃথিবীর সব দুধ নিয়ে আমার মুখের পানে অগ্রসর— মা! — এবার তিনজন এক সুরে, ঝিঁঝির ডাকের মতো হিহিহি হাসতে শুরু করে— ‘আয় জাদু, আয় সোনা, হিহিহি, আয় মণি, হিহিহি।’ আমি এক ঝটকায় দু’জনকে সরিয়ে তাদের ফাঁক গ’লে বেরিয়ে দৌড়তে থাকি, মরিয়া, অর্ধচেতন। পিছন থেকে তিন বুড়ির হিহিহি কোরাসে ভেসে আসে। বাতাসের ওঙ্কার, বৃষ্টির ঝঙ্কারকেও ডুবিয়ে দিতে চায়। বজ্রনির্ঘোষের মতো, কানের ভিতরে ফাটতে থাকে— ‘খেয়ে গেলি-নি বাপ! খেয়ে গেলি-নি!’ আমি ক’বার হোঁচোট খেলাম, ক’বার ক’-গাছের ধাক্কা লাগল, জানি না। জানি না, কতটা দূরে এসে, আমি দাঁড়িয়ে প’ড়ে হাঁফাতে থামলাম। একটা ঝলকে— ঐ ঐ নীচে গির্জাটা। এবার একটু কোনাকুনি— হার্মাদ জাহাজের মঙ্গের মতো। ঐখানেই ফিরতে আমাকে হবে। ওখানে আমার বন্ধু শাহিন আছে। কিন্তু নামি কীভাবে? কোন্ দিক্ দিয়ে কীভাবে উঠেছিলাম তা-তো মনে নেই। একটা পাকুড় গাছের নীচে দাঁড়াই (গাছটা পাকুড় কিনা জানি না), মনে-মনে একটা কী হিসাব কষি। মেলে না। মাথার উপরে এক অদ্ভুত সুড়সুড়ি। হাত দিই মাথায়। একটা দড়ি ঝুলছে, তারই ডগা। বরফ হ’য়ে যাওয়ার আগেই, একটা বিরাট্ লাফ দিয়ে ফেলতে পারি… আর, আমার গতি প্রচণ্ড বেড়ে যায়। শূন্যের ভিতর দিয়ে চললাম কিছুক্ষণ, টের পাই। অনেক নীচে আছড়ে পড়লাম, বলের মতো লাফিয়ে উঠে আবার পড়লাম, গড়াতে-গড়াতে ওল্টাতে-পাল্টাতে ভীষণ বেগে পড়তে লাগলাম, তা-ও টের পাই। আর, ঝমঝম বৃষ্টি মাটি খুবলে যেমন ঘাসের শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলছে, তেম্নি, একে-একে উপড়ে ভেসে যেতে থাকে লোকায়ত পান্থশালা— শান্তর অসীম অন্বেষা— শাহিনের স্বপ্নের মানচিত্র— একটা ভীষণ বুনো রাত— একটা সুন্দর মুখ। একটা সুন্দর সুন্দর মুখ।
স্কেচ- স্নেহা দাস